প্রবন্ধ- নবান্ন

নবান্ন

-ইন্দ্রনীল মজুমদার  

 

সেই কবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “দুরন্ত আশা” কবিতায় বলে গেছেন-
“অন্নপায়ী বঙ্গবাসী
স্তন্যপায়ী জীব”
অর্থাৎ বাঙালীজাতি অন্নকে এতোটাই ভালোবাসে যে এরা অন্নকে বিশেষ করে অন্নের ফ্যানকেও পান করে নেয়। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় যখন কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলের অর্ধকঙ্কাল মানুষ যখন খাবারের ভিক্ষে করে ভাতও পেল না তখন ভাত থেকে বর্জিত ফ্যানটুকু চাইলেও ফ্যান দিতেও কৃপনতা করেছিল এই জাতি। হায়! এই না বলে “রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি।” কিন্তু আপাতত এইসব ‘নেতি,নেতি’ ব্যাপার বন্ধ থাক কারণ সুখের কথা বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। উৎসবে ভরা আমাদের এই গোটা বঙ্গদেশ-পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ। তেমনি একটি উৎসব এই অন্নকে ঘিরেই যার নাম “নবান্ন”। “নবান্ন” শব্দটির অর্থ “নতুন অন্ন”।এই উৎসব আসলে দুই বাংলার ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব।গ্রামবাংলার কৃষক সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তাদের মধ্যে অন্যতম।

অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে বোনা এবং রোপা হয় আমন ধান। তাই এর স্থানীয় নাম জলিধান বা পৌষধান। এই আমন ধানকেই ঘিরে নবান্ন উৎসব। আসলে নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব এই নবান্ন। তাই এই উৎসব সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর অনুষ্ঠিত হয়। আবার কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদযাপন হয়। এই অনুষ্ঠানের রীতি হল নতুন অন্ন প্রথমে পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর কৃষি ঘরের গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড় সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।

এবারে আসি কাককে অন্ন উৎসর্গ করার প্রথায়। এই উৎসবের এক লৌকিক প্রথা অনুসারে নতুন আমন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা হয়। এটা আসলে এই উৎসবের একটি অঙ্গবিশেষ। “বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদুর।” তাই লোকবিশ্বাস অনুযায়ী কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। কাকের জন্য এই নৈবেদ্যকে বলে “কাকবলী”।

নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে। সেই শাস্ত্র অনুসারে, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণ বিধি অনুযায়ে নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়।আবার অতীতকালে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল।

এবার আলোচনা করা যাক “নবান্ন” উৎসবের সামাজিক তাৎপর্য নিয়ে। একদা অত্যন্ত সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব পালিত হত সেখানে সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিল। ১৯৯৮ সন থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন শুরু হয়েছে। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করে। ইদানীং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক নবান্ন উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী তাদের প্রকাশিত “শিশু” পত্রিকায় নবান্নের উপর একটি পৃথক সংখ্যা বের করে।বিজন ভট্টাচার্যের লেখা একটি বাংলা নাটকের নাম “নবান্ন” যা ১৯৪৪ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় ও শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় এই প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল।এরপর ১৯৪৮ সালে বহুরূপী নাট্যদলের প্রযোজনায় ও কুমার রায়ের পরিচালনায় নবান্ন মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকটির বিষয় পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ যাতে বাংলার ২০ লক্ষ মানুষ অনাহার, অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল।গণনাট্য সংঘ এই নাটকটিকে ভারতের নানা জায়গায় তাদের ‘ভয়েস অফ বেঙ্গল’ উৎসবের অঙ্গ হিসেবে মঞ্চস্থ করে দুর্ভিক্ষের ত্রাণে লক্ষাধিক টাকা তুলতে সক্ষম হয়েছিল।নাটকের প্রধান চরিত্র বাংলার এক চাষি প্রধান সমাদ্দার। এই নাটকের বিষয়বস্তু হল প্রধান সমাদ্দারের পরিবার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে অনাহারে কেমন কষ্ট পেয়েছিল তাই নিয়ে।

এই উৎসব কালেক্রমে আরো অনুষ্ঠিত হোক এই কামনাই রইলো।

Loading

2 thoughts on “প্রবন্ধ- নবান্ন

Leave A Comment